যে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বাধ্যতামূলক
প্রথম পাতা » ক্যাম্পাস » যে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বাধ্যতামূলকপ্রাইমডেস্ক : রোবটটার নাম রাখা হয়েছে ‘রোবট জি’। নিঃসঙ্গ মানুষকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এটি তৈরি করেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী চিরঞ্জিত বিশ্বাস ও সামিয়া ইন্তেসার। চতুর্থ বর্ষের গবেষণা প্রকল্পের অংশ হিসেবে এটি তৈরি করেছেন তাঁরা।
কণ্ঠনিয়ন্ত্রিত রোবটটি শিশুদের শিক্ষাদানের কাজেও ব্যবহার করা যাবে। চিরঞ্জিত বিশ্বাস জানান, রোবটটি ব্যবহারকারীর নির্দেশনা অনুযায়ী চলাচল করতে পারে, কথা বলতে পারে, গান শোনাতে পারে, বিখ্যাত ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য জানাতে পারে। রোবটটি প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, এটাকে কীভাবে আরও মানুষের উপকারে আনা যায়, এ বিষয়ে গবেষণা চলছে।
চিরঞ্জিত-সামিয়ার গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক শামীম আহসান বলেন, ‘রোবট নিয়ে কাজ করা ব্যয়বহুল। তবুও অল্প খরচে ভালো একটা প্রজেক্ট তৈরি করার চেষ্টা আমরা করেছি।’
বিভিন্ন ধরনের ড্রোনও উদ্ভাবন করেছেন এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এগুলোর কোনো কোনোটি আবহাওয়ার নানা উপাদান পরিমাপ করতে, আকাশ ও পানিতে চলতে সক্ষম। কোনোটি আবার কৃষিকাজে কীটনাশক ও সার ছিটানোর কাজে ব্যবহারোপযোগী।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলে তৈরি করেছেন ক্যাম্পাসে চুরি প্রতিরোধ ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণের মতো অ্যাপ। কীভাবে লবণাক্ত জমিতে ভালো ফসল পাওয়া যায়, সে বিষয়েও গবেষণা করছেন কেউ কেউ। উদ্ভাবন করার চেষ্টা করছেন নতুন নতুন ফসলের জাত।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শেষ বর্ষের সব শিক্ষার্থীর জন্য গবেষণা বাধ্যতামূলক। আর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণা করতে চাইলে আছে নানা সুযোগ-সুবিধা ও আর্থিক অনুদান। গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করতে স্থাপন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় গবেষণাগার। এখানে রয়েছে আরটি-পিসিআর যন্ত্রসহ উন্নত মানের গবেষণা যন্ত্রপাতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত চার বছরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে ৩ হাজার ১৯১টি গবেষণা প্রবন্ধ। এর মধ্যে গত বছরই প্রকাশিত হয়েছে ১ হাজার ২৬৬টি প্রবন্ধ। ফলপ্রসূ গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দও বাড়ানো হয়েছে। আয়োজন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক গবেষণা সম্মেলন, গবেষণা কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন দেশের ৪০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তিও করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ প্রতিবছর বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নানা ধরনের র্যাঙ্কিং করে থাকে। এসব র্যাঙ্কিংয়ের একটি ‘ইয়াং ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং’। বিশ্বের যেসব পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ৫০ বছর বা তার কম, সেগুলো নিয়েই এই র্যাঙ্কিং।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক উচ্চশিক্ষাবিষয়ক সাময়িকীর সম্প্রতি প্রকাশিত এই র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান তৃতীয়। আর বৈশ্বিক তালিকায় ৫০০-এর মধ্যে রয়েছে তারা।
গবেষণার মান, শিল্প, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি, গবেষণার পরিবেশ এবং শিক্ষাদানের মতো বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এই র্যাঙ্কিং করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মৌলিক লক্ষ্য, পাঠদান ও গবেষণার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও বিবেচনায় নিয়েছে তারা।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের নবম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। খুলনা শহর থেকে চার কিলোমিটার পশ্চিমে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কসংলগ্ন ময়ূর নদের তীরে এটির অবস্থান। গত বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, গল্লামারী-জিরোপয়েন্ট সড়কে পদচারী-সেতুর নির্মাণকাজ চলার কারণে প্রধান ফটকটি বন্ধ। বিকল্প ফটক দিয়ে ছায়া সুনিবিড় ক্যাম্পাসে ঢুকতেই মনে হলো, নিস্তব্ধতার রাজ্যে চলে এসেছি। শিক্ষার্থীদের আনাগোনা নেই বললেই চলে। ক্যাফেটেরিয়াসহ অন্যান্য আড্ডাস্থলেও শিক্ষার্থীর উপস্থিতি খুবই কম। কিন্তু এ অবস্থা কেন, ক্যাম্পাস তো খোলা।
অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মুহিব্বুল্লাহর সঙ্গে দেখা হলে সেই প্রশ্নটাই করলাম। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ডিসিপ্লিনের পরীক্ষা একই সঙ্গে এবং একই সময়ে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এখন পরীক্ষা চলছে। এ কারণে বাইরে শিক্ষার্থীরা কম ঘোরাঘুরি করছেন।’
১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে চারটি বিভাগে ৮০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই সেশনজটমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্বতন্ত্র ভাবমূর্তি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
বর্তমানে ৮টি অনুষদ ও ২৯টি ডিসিপ্লিনে এখানে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। দেশের দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এখানে খোলা হয়েছে ‘ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি’ বিভাগ। সুন্দরবন ও উপকূল নিয়ে কাজ করতে স্থাপিত হয়েছে ‘ইনস্টিটিউট ফর ইন্টিগ্রেটেড স্টাডিজ অন দ্য সুন্দরবনস অ্যান্ড কোস্টাল ইকোসিস্টেম’, দেশে যা প্রথম। বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলা হয়েছে দেশের প্রথম মাটি সংগ্রহশালা। আধুনিক ভাষা সেন্টার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজ শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার মান বিশ্বমানের করতে ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্স ইন টিচিং অ্যান্ড লার্নিং (সিইটিএল)’ এবং ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স সেল (আইকিউএসি) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ শিক্ষা-গবেষণা জোরদারে স্থাপন করা হয়েছে ‘দ্য অফিস অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স’।
৩৫ জন বিদেশিসহ প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন ৫ শতাধিক। ৩৩ বছরে ২৯টি ব্যাচে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন ১৩ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত কোর্স কারিকুলাম গত দুই বছরে আমরা পুরোপুরি পরিবর্তন করেছি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ‘আউটকাম বেজ এডুকেশন’ (ফলাফলভিত্তিক শিক্ষা) চলছে। এরপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে গবেষণায়। বিশ্বায়নের যুগে বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু পাঠদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না, জ্ঞানের সৃজন ও উদ্ভাবনের দিকেও নজর দিতে হবে। সেটিই করা হয়েছে। এটিকে আমরা ‘রিসার্চ ফোকাসড’ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছি। এ জন্য ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাতও কমিয়ে আনা হয়েছে। ফলে শিক্ষকদের সংস্পর্শে বেশি সময় থাকার সুযোগ পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। কীভাবে গবেষণা করবেন, কীভাবে গবেষণা প্রস্তাব প্রস্তুত করবেন, স্নাতক পর্যায়েই একজন শিক্ষার্থী তা শিখে যাচ্ছেন। আগ্রহ থাকলে ওই শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গিয়ে বৃহৎ আকারে গবেষণা করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তখন তাঁকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। আগামী পাঁচ বছরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কোন ধরনের হওয়া উচিত, সেই বিষয়েও একটি ‘গবেষণা কৌশল পরিকল্পনা’ করা হয়েছে।
অধ্যাপক মাহমুদ হোসেন
উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়