রবীন্দ্র দৃষ্টিতে শিশুশিক্ষা
প্রথম পাতা » লোকশিক্ষা » রবীন্দ্র দৃষ্টিতে শিশুশিক্ষা
প্রাইমডেস্ক : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বাঙালি মানসের অফুরন্ত বিস্ময়ের অন্তহীন উৎস। তিনি কবি, গল্পকার, চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানপ্রেমিক, সমালোচক, ভাষাচিন্তাবিদ, চিত্রশিল্পী, রাজনীতি-ভাবুক, দেশি-বিদেশি ভাবনার সংশ্লেষক, সমাজ ও রাষ্ট্র আন্দোলনের অগ্রণী পথিক, অনন্য শিক্ষাপদ্ধতির উদ্ভাবক ও পরীক্ষক। জীবনের প্রায় চল্লিশটি বছর বিদ্যমান ঔপনিবেশিক শিক্ষা-কাঠামোর বাইরে গিয়ে বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন; স্থাপন করেছেন তিনটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান।
সাহিত্য-সাধনার পাশপাশি দীর্ঘকাল ধরে এই কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেছেন তিনি। সমগ্র ভারতবর্ষে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাতত্ত্বের উদ্ভাবক ছিলেন তিনি। ভারতীয় ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সঙ্গে পাশ্চাত্যের শিল্প ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর অনন্য শিক্ষাতত্ত্ব। দেশীয় শিক্ষারীতিকে তিনি সমকালের উপযোগী করে নিয়েছেন এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদদের ভাবনাকেও শিক্ষাক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন।
স্বীয় শিক্ষা পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য তিনি যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন বর্তমানকালেও সেগুলো প্রশংসনীয় এবং অনুকরণযোগ্য। তার প্রবর্তিত লোকশিক্ষা, স্বাস্থ্যশিক্ষা, কৃষি-উন্নয়নমূলক শিক্ষা, পরিবেশ শিক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, আজকের সমাজে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পরিপূর্ণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে মানবসম্পদে রূপান্তরের যে উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেছিলেন বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। ব্যক্তির অন্তর্গত সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটিয়ে তাকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা তাঁর শিক্ষাদর্শের মৌল বৈশিষ্ট্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশুদের শিক্ষা নিয়ে ভেবেছেন। ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষাব্যবস্থাকে শিশুমনের অনুপযোগী মনে করতেন তিনি। সাধারণত শিশুদের আমরা প্রথাগত পাঠ্যক্রমের বাইরে এক পাও যেতে দিই না। অত্যাবশ্যক বিষয়কে কেন্দ্র করেই তাদের পঠন-পাঠন চলে। এরূপ শিক্ষায় আর যাই হোক শিশুদের মন বড় হয় না।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেন, “অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না—বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমাণে বালক থাকিয়াই যায়।” তাঁর মতে, এই অবস্থার কারণ, দ্রুত চাকরিতে ঢোকার তাগিদ এবং মাতৃভাষা বাংলা ও বিভাষা ইংরেজি কোনোটাই ভালো মতো শিখতে না পারা। এর পাশাপাশি রয়েছে মাতৃভাষা বাংলায় রচিত গ্রন্থের স্বল্পতা।
এমন পরিস্থিতিতে বাঙালি ছেলেদের অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “বাঙালির ছেলের মতো এমন হতভাগ্য আর কেহ নাই। অন্য দেশের ছেলেরা যে বয়সে নবোদ্গত দন্তে আনন্দমনে ইক্ষু চর্বণ করিতেছে, বাঙালির ছেলে তখন ইস্কুলের বেঞ্চির উপর কোঁচা-সমেত দুইখানি শীর্ণ খর্ব চরণ দোদুল্যমান করিয়া শুদ্ধমাত্র বেত হজম করিতেছে, মাস্টারের কটু গালি ছাড়া তাহাতে আর কোনোরূপ মশলা মিশানো নাই।”এর সাথে রয়েছে আনন্দহীন যান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, যে শিক্ষা কণ্ঠস্থ কিংবা গলধঃকরণ করতে শেখায়—বুঝতে বা হজম করতে শেখায় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শৈশবের শিক্ষার অভিজ্ঞতাও মধুর ছিল না। ১৯২৪ সালে জাপানের একটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সামনে দেওয়া ভাষণে তিনি স্বীয় শৈশবকালীন শিক্ষাজীবন সম্পর্কে বলেছিলেন, “When I was thirteen, I finished going to school. 1do not want to boast about it, I merely give it you as a historical fact […]. So long as I was forced to do so, I felt the torture of going to school unsupportable. I often used to count the years that must pass before I should find my freedom.”
শিশুশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন তপোবনের আশ্রমিক প্রশান্তি। তপোবনের উন্মুক্ত প্রান্তরে থাকবে প্রকৃতি ও প্রকৃত গুরুর সান্নিধ্য যা একজন শিষ্যকে প্রাণবন্ত ও সজীব করে তোলে। তিনি শিশুদের বিশ্বপ্রকৃতির অত্যন্ত কাছের মনে করতেন। প্রকৃতির সঙ্গে যোগ শিশু প্রাণে গতি সঞ্চার করে। বয়স্কদের অনুশাসন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শিশু-মন ছটফট করতে থাকে। কোন রকম কৃত্রিমতাকে তারা আশ্রয় দেয় না। তাই তাঁর পরামর্শ হলো, “বিশ্বপ্রাণের স্পন্দন লাগতে দাও ছেলেদের দেহ মনে, শহরের বোবা কালা মরা দেয়ালগুলোর বাইরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। ‘The Schoolmaster’(১৯২৪) প্রবন্ধ অবলম্বনে সেগুলো হলো : প্রথমত কোনো তত্ত্বের ভিত্তিতে শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত নয়। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে; দ্বিতীয়ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে খাঁচা না হয়ে আনন্দক্ষেত্র হতে হবে যেখানে বৈচিত্র্য ও আনন্দ থাকবে। আনন্দের মধ্য দিয়ে সেখানে পাঠদান করা হবে, কোনোভাবেই বিদ্যা গেলানো হবে না; তৃতীয়ত শিশুদের নিকট থেকে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা না করে শিশুমনের উচ্ছ্বাস ও কৌতুহলকে মূল্য দিতে হবে; চতুর্থত শিশুদের খেলার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা অনায়াসেই শিখতে পারবে। শিক্ষাকে যদি বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তারা শিখতে পারবে না; পঞ্চমত শিক্ষারক্ষেত্রে শিশুদের স্বাধীনতা দিতে হবে।
স্বাধীনভাবে গড়ে উঠলেই শিশুদের সত্যিকারের মানসিক বিকাশ ঘটে। শিশুদের যথার্থ মানসিক বিকাশের স্বার্থে মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার অবাধ স্বাধীনতা দিতে হবে; ষষ্ঠত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যকার ব্যবধান দূর করতে হবে। শিক্ষকদেরকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের প্রতিভূ না হয়ে শিক্ষার্থীর প্রতি বন্ধুসুলভ হতে হবে যেন তারা শিক্ষকদের দেখে ভীত না হয়। শিক্ষককে শিক্ষার্থীর বন্ধু ও পথপ্রদর্শকের কাজ করতে হবে। এ ধরনের সম্পর্ক গড়ে না উঠলে শিক্ষকের শিক্ষকতা কার্যকর হয় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন শিশুদেরকে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, মাটি ও মানুষের সাথে সম্পৃক্ত করে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে। দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং ভাষা ও পারিপার্শ্বিক আবহে সম্পৃক্ত করে শিশুদের স্বাধীন শিক্ষায় শিক্ষিত করতে তিনি সব সময়ই উদ্যোগী ছিলেন। তিনি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার ভিত মাতৃভাষার মাধ্যমে গড়ে দিতে চেয়েছিলেন যাতে শিশুরা বাংলা ভাষার প্রাণস্পন্দনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে শিক্ষাকে গভীরভাবে আয়ত্ব করে নিতে পারে। তিনি মনে করতেন, শিক্ষায় স্বদেশি ভাষা অবলম্বন করলে মনের বিশেষ উন্নতি হয়। ভাব প্রকাশ করার সুযোগ ঘটে।
এতে যে কেবল কতকগুলো মুখস্থ জ্ঞান অর্জন হয় তা নয়, এতে শিশুর মানসিক শক্তিরও বিকাশ হতে থাকে। তিনি বিশ্বাস করতেন, পরভাষার মধ্য দিয়ে পরিস্রুত শিক্ষায় বিদ্যার প্রাণ-পদার্থ নষ্ট হয়ে যায়। এ থেকে বাঁচতে হলে, পরাসক্ত মনকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলোকে শিশুকাল থেকে নিজের ভাষার ভিতর দিয়ে গ্রহণ ও প্রয়োগের চর্চা করতে হবে। মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার লাভ অনেক।
মাতৃভাষায় শিক্ষা দিলে শিক্ষার্থী যেমন পঠিত বিষয়কে সম্যকভাবে আত্মস্থ করতে পারে তেমনি সে নিজের ভাবকেও উত্তরূপে প্রকাশ করতে পারে এবং তার মধ্যে উদ্ভাবনী শক্তি তথা সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। কারণ তার মধ্যে শেখার ও প্রকাশের ভাষার মধ্যে কোনো ব্যবধান থাকে না। এছাড়া মাতৃভাষা জ্ঞানচর্চার আধার হলে এই ভাষায় সাহিত্য ও গ্রন্থ রচনার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ফলে ভাষার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটে।
শিশু-শিক্ষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবল মাতৃভাষার প্রতিই গুরুত্ব দেননি—প্রকৃতি এবং পরিবেশের কথাও বলেছেন। আমাদের শিক্ষায় আকাশ-বিশ্বপ্রকৃতি-নদী-প্রান্তর-ফুল-ফল-পাখি-জল-স্থল-সাগর-পাহাড়-পর্বত-জীবন-জগৎ-দেশ-মাটি-মানুষের স্পর্শ নেই—আছে কেবল কারাগার স্বরূপ একটি কক্ষ, কিছু নোট বই আর শিক্ষকের তৈরি করে দেয়া কিছু প্রশ্নোত্তর। এই শিক্ষায় মনুষ্যত্বের বিকাশ সম্ভবপর নয়। শিক্ষায় বিশ্বপ্রকৃতি, দেশ, মাটি ও মানুষের গভীর সম্পর্ক থাকলে তবেই মানুষ হওয়া সম্ভব হয়।
শিশু-শিক্ষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পারিবারিক শিক্ষা ও পারিবারিক পরিবেশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। একটি শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলার সমস্ত দায়িত্ব আমরা শুধু শিক্ষকের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত হয়ে থাকি। কিন্তু পারিবারিক পরিবেশেও যে শিশুকে শিক্ষার উপযুক্ত করে তুলতে হয় তা আমরা আদৌ মনে করি না। মনুষ্যত্বের স্বকীয় আদর্শ যে কেবল বিদ্যালয় বা পাঠাগারের মধ্যে নয়, পরিবারের মধ্যেও, এই সত্য আমরা ভুলে যায়। আমরা শিশুকাল থেকেই শিশুদের মধ্যে ইতরতার বিষ ঢুকিয়ে দিই। এই বিষের হাত থেকে মুক্তি পাবার উপায় পরীক্ষায় পাসের জন্য পড়া মুখস্থ করা নয় বরং মানুষের ইতিহাসে যা কিছু ভালো তার সঙ্গে আনন্দময় পরিচয় সাধন করিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করার সুযোগ ঘটিয়ে দেওয়া।
শিশু-শিক্ষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আনন্দবাদী। যে শিক্ষায় আনন্দ নেই, প্রাণ নেই আর যে শিক্ষা মাতৃভাষার মাধ্যমে আত্মস্থ না করে শুধু মুখস্থ মাত্র—সেই শিক্ষাকে তিনি কৃত্রিম ও গোলামির শিক্ষা বলেছেন। ঔপনিবেশিক শিক্ষালয়গুলোকে তিনি কোমলমতি শিশু ও ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে একটা কঠিন কারাগার রূপে তুলনা করেছেন। তিনি শিশুদেরকে বিদ্যালয়ে অত্যাবশ্যক শিক্ষাদানের সাথে সাথে স্বাধীন পাঠের সুযোগও দিতে বলেছেন যাতে তারা ভাল করে মানুষ হতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশু-শিক্ষাভাবনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নীতিশিক্ষা। তিনি শিশুদের নীতিশিক্ষা দিতে চেয়েছেন। ‘ছাত্রদের নীতিশিক্ষা’(১২৯৯) শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি নীতিশিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন। তিনি ধর্মকে অবলম্বন করে, আইন অনুযায়ী দণ্ড, সামাজিক নিন্দার ভয় দেখিয়ে কিংবা উপদেশ দিয়ে নীতিশিক্ষা দানের পক্ষপাতী নন। তিনি শিশু-চরিত্রের দোষ দূর করার চেষ্টার পূর্বে দোষের কারণটা অনুসন্ধানের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতি সাধনার শিক্ষা দেয়ার ইচ্ছা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুরু থেকেই ছিল। “যখন শান্তিনিকেতনে প্রথম বিদ্যালয় স্থাপন করি তখন এই লক্ষ্যটাই আমার মনে প্রবল ছিল।” সাধারণ স্কুলে যে যথার্থ সংস্কৃতি-চর্চার সুযোগ নেই, তিনি এটা জানতেন। তাই তিনি স্বীয় প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে সংস্কৃতি-চর্চার ব্যবস্থা করেছিলেন। “সাধারণ ইস্কুলে এই সাধনার সুযোগ নেই, আমাদের আশ্রমে আছে। এখানে নানা বিভাগে নানা কর্ম চলছে, তার মধ্যে শক্তি প্রয়োগ করাতে পারে এমন অবস্থা থাকা চাই।”
শন্তিনিকেতন আশ্রমে একাজে তাঁকে সহায়তা করতেন সতীশ রায় এবং অজিত চক্রবর্তী। তাদের সতর্ক ও বলিষ্ঠ প্রচেষ্টায় বইয়ের পাতা অতিক্রম করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মধ্যে সংস্কৃতি প্রবেশ করেছিল। শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, সংস্কৃতি সাধনার শিক্ষাপ্রাপ্ত আশ্রমের ঐসকল ছাত্ররা “নিন্দাবিলাসী নয়, পরশ্রীকাতর নয়, অক্ষমকে সাহায্য করতে তারা তৎপর এবং ভালোকে তারা ঠিকমত যাচাই করতে জানে।”
শিশুদের যথার্থভাবে শিক্ষাদানের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথাগত শিক্ষকের পরিবর্তে গুরুকে চাইতেন। শিক্ষকের চেয়ে গুরুই ছিল তাঁর কাছে অধিকতর পছন্দের। যে গুরু অর্থের জন্য কিংবা দায়িত্বের খাতিরে শিক্ষার্থীকে পাঠদান করবেন না, পাঠদান করবেন অন্তরের অমৃতকে পরিবেশনের জন্য। আর শিক্ষক যদি চাইতেন, তাহলে সেই শিক্ষককে হতে হবে শুভ্রকেশ সৌম্যমূর্তি প্রফেসর হেনরি মর্লির মতো। সতেরো বছর বয়সে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে যাকে তিনি পেয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসে। যার কাছে ক্লাসে পাঠদান ছিল, “পড়ার বই থেকে চালান দেওয়া শুকনো মাল নয়। সাহিত্য তাঁর মনে, তাঁর গলার সুরে প্রাণ পেয়ে উঠত—আমাদের সেই মরমে পৌঁছত যেখানে প্রাণ চায় আপনখোরাক, মাঝখানে রসের কিছুই লোকসান হত না।”রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও চাইতেন এইরূপ শিক্ষক হতে। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’(১৯৩২) প্রবন্ধে তিনি সে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশুশিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন শ্রেণিবিশেষের প্রতি পক্ষপাত এড়িয়ে। তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল শিক্ষার আলো সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে সবাইকে অজ্ঞতার হাত থেকে মুক্তি দেওয়া। এ থেকে বুঝা যায় তিনি রেনেসাঁসের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রকৃত শিক্ষার বিস্তারকে যথাযথ মূল্যে গ্রহণ করেন। জাতির আগামীদিনের ভবিষ্যৎ যে শিশুরা তাদের মনুষ্যত্ববোধ ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন যথার্থ মানুষ তৈরির জন্য প্রকৃতির সান্নিধ্যে মাতৃভাষায় স্বদেশি শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। শিশুশিক্ষা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি শিশুদের আলোকিত মানুষ রূপে গড়ে তোলার উপযোগী একটি শিক্ষাদর্শন যার সবটাই চারিত্র্যধর্মে আধুনিক ও প্রগতিশীল, কালোপযোগী হয়েও কালোত্তর।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
আর্কাইভ
চেয়ারম্যান, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি ।
প্রধান উপদেষ্টাঃ প্রফেসর ড. ইঞ্জিনিয়ার মোঃ হুমায়ুন কবির
উপাচার্য, প্রাইম ইউনিভার্সিটি
সম্পাদকঃ লুৎফর রহমান জয়
হটলাইনঃ ০১৭১১১৩১৬৮৫